Sunday, March 19, 2017

৪৩ ইতিকথা

 এই লেখাটা আমি যখন শুরু করি, মনে হয়েছিল মাত্র কয়েকটা ঘনার মধ্য দিয়েই এটা শেষ হয়ে যাবে কিন্তু তই সামনে এগুচ্ছিলাম, মানস পটে চলচ্চিত্রের মত একের পর এক ভেসে উঠছিল নতুন ঘটনা, নতুন মুখ, নতুন নাম কখনো কখনো মুখগুলোর কোন নাম ছিল না, আবার কখনো বা নামগুলোর ছিল না কোন অবয়ব সময়ের সাথে আমি এটাও উপলব্ধি করি যে মহাকালের এই অন্তহীন সময় অক্ষে ১৯৭১ শুধু টাইম ইন্টারভাল বা সময়ের রেখাংশ নয়, এর বিস্তৃতি একাত্তরকে ছাড়িয়ে আমাদের বর্তমানেও বিরাজমান বুঝেছি কিভাবে একাত্তরের দিনগুলি তিলে তিলে গড়ে তুলেছে বর্তমানের আমাকে, বর্তমানের আমিকে এই লেখাটা না লিখলে নিজেকে জানাটাই অনেকাংশে অসম্পূর্ণ থেকে যেতো


লেখাটা যখন পর্বে পর্বে ব্লগে প্রকাশ করেছি, অনেকেই বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করেছে। কেউ বলেছে, এটা তাকে একাত্তরে ফিরিয়ে নিয়ে যায়, কেউ বা অনুরোধ করেছে হুট করে  লেখাটা  শেষ না করতে, কেউ বা আবার এটাকে বইয়ের আকারে দেখতে চেয়েছে। কেউবা সমালোচনা করেছে দেশের বর্তমানের উন্নতির দুধে এভাবে ঘোল ঢালায়। আর আমি এসব কিছু না ভেবে লিখে গিয়েছি মনের আনন্দে। কেনন না যখনই আমরা ফলের চিন্তা করি, সে চিন্তাটাই আমাদের এমন ভাবে ঘিরে আর ঘোরে রাখে যে ভুলে যাই কাজের আনন্দ। আর প্রফুল্ল চিত্তে কাজ না করলে সেটা হয় রস বর্জিত। এজন্যেই হয়তো জীবনে প্রফেশনাল হতে পারলাম না, না পদার্থবিদ্যায়, না ফটোগ্রাফিতে, না লেখায়। প্রফেশনাল মানুষ স্বীকৃতি চায় কাজের পরে, আর আমি চাই কাজের আনন্দ, ফলের চিন্তা না করে কাজের আনন্দেই কাজ করে যাই। আমার লেখা, এটা নিজের সাথে নিজের কথা বলা এটা যতটা না ঘটনার বর্ণনা তার চেয়ে বেশী মনের বর্ণনা, মানসিক অবস্থার বর্ণনা। এটা যতটা না উত্তর তার চেয়ে অনেক অনেক বেশী প্রশ্ন।


একাত্তরের যুদ্ধটা ছিল নানামুখী, একেক জন মানুষ একেক লক্ষ্যে এই যুদ্ধে নামে আর দিনের শেষে এই যুদ্ধে কেউ পরে বিজয়ের মাল্য, কারো কপালে জোটে পরাজয়ের গ্লানি বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবীর জন্য এটা ছিল রবীন্দ্র- নজরুলের হাত ধরে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠা করা আর একই সাথে বাংলা ভাষার উপর কলকাতার এক চেটিয়া অধিকার খর্ব করা বাংলার উচ্চবিত্ত চাইতো পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পপতিদের মতই বিশ্ব বাজারে নিজেদের নক্ষত্র উদিত হতে দেখতে আর হিন্দু মধ্যবিত্ত, যারা মাত্র পঁচিশ বছর আগেও অবিভক্ত বাংলার শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি অঙ্গনে ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী, চাকুরী, বানিজ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছিল অগ্রগামী, ভারত বিভাগ যাদেরকে করেছে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে ভবিষ্যৎহীন, চেয়েছিল যদি না অতীত গৌরব, অন্তত মান মর্যাদা নিয়ে নিজ ভূমে বেঁচে থাকার, কাজ করার অধিকার নিম্নবিত্ত সাধারন মানুষের অবশ্য কোন আশা আকাঙ্খাই ছিল না ২৪ বছর আগে এরাই মুসলিম লীগকে ভোট দিয়ে ভারত ভেঙ্গে পাকিস্তান তৈরির রাস্তা করে দিয়েছিল, আবার ১৯৭০ তারাই শেখ সাহেবের আওয়ামী লীগকে নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা দিয়েছিল যখন পাকিস্তানের সামরিক শাসক তাদের রায়কে অমান্য করে অন্যায় ভাবে দেশের উপর হামলা চালায়, এই জনতা যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে নেমে পরে শত্রুর মোকাবেলায় তাদের জন্য এটা ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের যুদ্ধ আবার এমন মানুষও ছিল, যারা তখনও পাকিস্তানের স্বপ্নে বিভোর ছিল, যারা সব সময় সরকারের আশেপাশে থাকতো আর সরকারের ভালো মন্দ সব নীতি থেকেই ফায়দা লুটতো এদের ভালমন্দ ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে ছিল এই মাটিতে পাকিস্তানী শাসন, শোষণ টিকে থাকার উপর এরাই রাজাকার, আল-বদর বিভিন্ন নামে দল ভারী করে হানাদার বাহিনীর


স্বাধীন দেশ – এটা যতটা না কোন ভূখণ্ড বা সেই ভূখণ্ডের মানুষ, তার চেয়েও বেশী সেই জাতির সামনে চলার পথ, তার সংবিধান বাহাত্তরের সংবিধান শুধু মাত্র এই যুদ্ধে বিজয়ী শক্তির চিন্তা ভাবনার বহিঃপ্রকাশ নয়, এটা তখনকার আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির প্রতিফলন ভারতের সার্বিক সহযোগিতা যেমন জয় এগিয়ে এনেছে, তেমনি ভাবে সাহায্য করেছে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকে গ্রহন করতে, ভারত যার প্রবক্তা ছিল স্বাধীনতার প্রথম দিন থেকেই অন্য দিকে একাত্তরের মুক্তি সংগ্রামে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন সমাজতন্ত্রকে জায়গা করে দিয়েছে সংবিধানে আর গনতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ ছাড়া কোন সংবিধান কি সম্পূর্ণ হতে পারে? তাই সব দিক বিচার করলে বাহাত্তরের সংবিধান – এটা পাকিস্তানের কবল থেকে এই ভূখণ্ডের মুক্তির জন্য লড়াই করা সকল মানুষের বা সকল গোষ্ঠীর চিন্তা ভাবনার ফসল, এটা ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তে লেখা পথ নির্দেশিকা
এর আগে বেশ কয়েক জায়গায় লিখেছি এই লেখাটা না লিখলে আমার নিজেকে জানা অসম্পূর্ণ থাকতো। একটা সময় ছিল, যখন ভাবতাম শেখ মুজিবকে জানার, চেনার বাকী নেই আমার। জন্ম ১৯৬৪ সালে, বুদ্ধি হবার পর থেকেই যে নামটা সবচেয়ে বেশী করে শুনেছি, সেটা শেখ মুজিবের নাম। ১৯৬৯, ১৯৭১ – সবাই বলে মুজিব মুজিব। কিন্তু কয়েক বছর আগে তার “অসমাপ্ত আত্মজীবনী” পড়ে বুঝলাম, কত কম তাকে জানি। কেন না, আমার কাছে শেখ মুজিব ছিলেন বাংলাদেশের অপর নাম, পাকিস্তানের প্রধান এবং প্রবল প্রতিপক্ষ।  কিন্তু তার বই থেকে যখন জানলাম, এই বাংলায় পাকিস্তান আন্দোলনকে তিনিই জনপ্রিয় করেছেন, প্রথমে বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয়েছিলো। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা তিনি যেভাবে ধীরে ধীরে নিজেকে একজন সত্যিকারের বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী নেতায় পরিনত করতে পেরেছিলেন। মনে পড়লো মহাত্মা গান্ধীর কথা। গান্ধীর আগ পর্যন্ত কংগ্রেস ছিল মুলত ব্রিটেনে শিক্ষালাভকারী ভারতীয়দের ক্লাব। গান্ধীই যেমন সর্বপ্রথম কংগ্রেসের রাজনীতিকে গনমানুষের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন, ঠিক তেমনি করেই শেখ মুজিব গনমানুষের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন মুসলিম লীগের রাজনীতি। কিন্তু দেশ বিভাগের পরেই তিনি বুঝতে পারেন বাঙ্গালী জাতির মুক্তি পাকিস্তানের কাঠামোতে হতে পারে না, সেখান থেকেই শুরু হয় তার রাজনৈতিক বিবর্তন, আর সেই পরিবর্তনের হাতে ধরে তিনি ডাক দেন মুক্তি সংগ্রামের। জাতি পায় নতুন ছাড়পত্র – যার নাম বাহাত্তরের সংবিধান। কিন্তু এই পরিবর্তনের, এই বিবর্তনের মধ্যেও যে জিনিষটা ধ্রুবতারার মত ছিল শেখ মুজিবের রাজনৈতিক আকাশে, সেটা হল – মানুষ। তিনি সব সময়ই গনমানুষের রাজনীতি করতেন, রাজনীতি করতেন মানুষের জন্য, মানুষের উপর আস্থা রেখে, মানুষকে নিয়ে। আর রাজনীতির এই উপাদানটারই  আজকে দেশে বড় অভাব।


অনেক সময় অনেককে বলতে শুনেছি সমাজের বিবর্তন স্পাইরাল আকারে হয়। এটা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ পড়াতে গিয়ে আমাদের বলতো শিক্ষকরা বা রাজনৈতিক গুরুরা। তবে সেই স্পাইরাল স্বাভাবিক ভাবেই সময়ের সাথে উন্নত স্তরে পৌঁছুত। বর্তমানে দেশের রাজনীতি দেখে মনে হয় আমাদের এই উন্নতি আটকে গেছে, সময়ের সাথে আমরা রাজনীতিকে উন্নত স্তরে নিয়ে যেতে পারছি না। দ্বিজাতিতত্তের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত সাম্প্রদায়িক রাজনীতি দিয়ে শুরু করেছিলেন শেখ মুজিব তার রাজনৈতিক জীবন, পরে সেই রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করে জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গনতন্ত্র আর সমাজতন্ত্রের রাজনীতিতে দীক্ষিত হন তিনি। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশে আবার সাম্প্রদায়িক রাজনীতি মাথাচারা দিয়ে উঠেছে। ধর্মই হয়ে উঠছে রাজনীতির লাভ লোকসানের একমাত্র নীতিনির্ধারক।    


আজকাল দেশে প্রায়ই শোনা যায় স্বাধীনতার পক্ষের বা বিপক্ষের শক্তির কথা এটা মূলত রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ কোন ব্যক্তির কোন বিশেষ দলের বা ধারার রাজনীতির প্রতি আনুগত্য বা অনানুগত্য দিয়ে বিচার করা হয় সে কোন ঘরানার লোক আমি ব্যাক্তিগত ভাবে এই বিভাজন অনেক আগে থেকেই বিশ্বাস করি না আন্তর্জাতিক আইনকানুন বলি, আর ব্যক্তি স্বার্থেই বলি, বাঙ্গালী জাতি আর কোন দিন কারো তাবেদার হবে এটা আমি মনে করি না এগুলো রাজনীতির খেলা, রাজনীতির ভাষা তবে আমি মনে করি দেশ এখন দুটো বড় ভাগে বিভক্ত – এক দল একাত্তরের চেতনা ধারন করে, অন্যদল এই চেতনাকে মুছে দিতে চায় আর একাত্তরের চেতনা যারা মুছে দিতে চায় তাদের আনাগোনা যেমন তথাকথিত স্বাধীনতা বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির দলে, তেমনি স্বাধীনতার পক্ষের রাজনৈতিক দলের মাঝেও ওরা একাত্তরের চেয়ে অনেক বেশী সুসংগঠিত, অনেক বেশী ঐক্যবদ্ধ ভোটের রাজনীতির খপ্পরে পড়ে অনেকে এটা বুঝেও না বুঝার ভান করে আর এটাই হচ্ছে দেশ হিসেবে নয়, জাতি হিসেবে স্বাধীন, সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ বাঙ্গালী জাতির টিকে থাকার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ দেশের উন্নতির জন্য, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার জন্য আমাদের আর একাত্তরের যুদ্ধের দরকার নেই, দরকার একাত্তরের চেতনা জীইয়ে রাখা, শিক্ষা, সংস্কৃতি সব কিছুর মাধ্যমে এই চেতনা প্রজন্মের পর প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। একমাত্র এই চেতনাই পারে দেশকে সামনে নিয়ে যেতে, বাঙ্গালী জাতিকে বিশ্বের দরবারে মহিমান্বিত করতে।                              

মস্কো, ১৯ মার্চ ২০১৭
                          





                                   সমাপ্ত